রেশমার সফলতার গল্প

‘রেশমা নামেই সবাই চেনেন, বাবা বা স্বামীর নাম বলতে হয় না। আমার এলাকায় এসে রেশমার বাড়ি বা ভার্মি কম্পোস্ট সার কে বানাচ্ছেন, তা জানতে চাইলেই সবাই আমার বাড়ি দেখিয়ে দেন।’ এভাবেই কথাগুলো বলছিলেন সুরাইয়া ফারহানা রেশমা। তিনি একজন নারী উদ্যোক্তা।

রেশমা গত মঙ্গলবার যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের ‘জাতীয় যুব পুরস্কার-২০২২’ পেয়েছেন। রাষ্ট্রীয়ভাবে পেয়েছেন সফল আত্মকর্মীর স্বীকৃতি। পুরস্কারপ্রাপ্তদের মধ্যে রেশমা জাতীয় পর্যায়ে দ্বিতীয় হয়েছেন। এই পুরস্কার তাঁর ‘রেশমা কৃষি উদ্যোগ’ নামের সমন্বিত কৃষি খামারের জন্য।

যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের ‘সফল যুবদের কথা’ শিরোনামে প্রকাশনায় উল্লেখ করা হয়েছে, রেশমার খামারের সব খরচ বাদ দিয়ে বছরে নিট লাভ ৪০ লাখ টাকা। তাঁর বর্তমান মূলধনের পরিমাণ এক কোটি দুই লাখ টাকা। রেশমা তাঁর প্রকল্পে ১৬ জন নারীর কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছেন। রেশমার কাজ দেখে আরও ২০ জন আত্মকর্মী হয়েছেন।
একসময় রেশমার দিনগুলো আজকের মতো ছিল না। সে সময়ের স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘একসময় মানুষ প্রথমেই জানতে চাইতেন, বাবা কী করেন? বাবার পরিচয় দিতে পারতাম না। আমার যখন দুই মাস বয়স, তখন বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করে মা ও আমাকে ছেড়ে চলে যান।’

রেশমার বিয়ে হয়েছিল মাত্র ১৪ বছর বয়সে, অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময়। বিবাহিত জীবনেও তাঁকে বিড়ম্বনার মুখে পড়তে হয়েছে। এ নিয়ে রেশমা বলেন, ‘মানুষের প্রশ্ন থাকত—স্বামী কী করেন? আমার স্বামী নেশা করতেন, জুয়া খেলতেন। মায়ের কাছ থেকে টাকা এনে দিতে বলতেন। দিতাম না বলে মারধর করতেন। তাই চার বছর সংসার করার পর মায়ের কাছে ফিরে আসি।’

বাবা ও স্বামীকে নিয়ে নানাজনের প্রশ্নই তাঁর জীবনে বদল আনা শুরু করে বলে জানালেন রেশমা। তাঁর ভাষায়, ‘সবার প্রশ্নে মনে হতো, এ সমাজে বাবা আর স্বামীর পরিচয় ছাড়া যেন মেয়েদের আর কোনো পরিচয় নেই। জেদ চাপে যেন নিজের পরিচয়ে বাঁচতে পারি। রেশমা নামেই যাতে সবাই চেনেন, সেই লড়াই শুরু করি।’

মঙ্গলবার রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে রেশমা পুরস্কার হিসেবে ৯০ হাজার টাকার চেক, ক্রেস্ট ও সনদ পেয়েছেন। পুরস্কার পাওয়ার পর শোনান তাঁর জীবনের নানা সংগ্রামের কথা।

রেশমা বগুড়ার মেয়ে। ফেসবুকে পেজ খুলেছেন ‘রেশমা কৃষি উদ্যোগ’ নামে। ‘ভার্মি কম্পোস্ট’ নাম দিয়ে কেঁচো সারের বস্তা বিক্রি করেন তিনি। নিজের ও খামারের নামে ভিজিটিং কার্ডও আছে। ক্রেতারা কেঁচো সার কেনার জন্য ফোন দিচ্ছিলেন।

পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের পরিবার কল্যাণ সহকারী হিসেবে কাজ করছেন তিনি। হোসনে আরাও বাল্যবিবাহের শিকার হয়েছিলেন। রেশমার আগে আরও তিন সন্তানের জন্ম দেন তিনি। তবে সেই সন্তানেরা বাঁচেনি। রেশমার দুই মাস বয়সে হোসনে আরার স্বামী দ্বিতীয় বিয়ে করেন, ছেড়ে চলে যান স্ত্রী ও সন্তানকে। হোসনে আরা মেয়েকে নিয়ে তাঁর মায়ের কাছে আশ্রয় নেন।

রেশমা বললেন, তাঁর নিজের নামে পরিচিত হওয়া বা রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পাওয়ার পেছনে মা হোসনে আরার অবদান সব থেকে বেশি। মা তাঁর মায়ের (রেশমার নানি) কাছ থেকে যে জায়গা-জমি পেয়েছিলেন, তা রেশমার নামে লিখে দিয়েছেন। সেই জায়গা ও পরে আরও জমি কিনে রেশমা তাঁর উদ্যোগের পরিধি বাড়িয়ে চলেছেন।

যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের ‘সফল যুবদের কথা’ শিরোনামে প্রকাশনায় উল্লেখ করা হয়েছে, রেশমার খামারের সব খরচ বাদ দিয়ে বছরে নিট লাভ ৪০ লাখ টাকা। তাঁর বর্তমান মূলধনের পরিমাণ এক কোটি দুই লাখ টাকা। রেশমা তাঁর প্রকল্পে ১৬ জন নারীর কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছেন। রেশমার কাজ দেখে আরও ২০ জন আত্মকর্মী হয়েছেন।

যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর ও বগুড়ায় কর্মরত বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন রেশমা। বলেন, এই অধিদপ্তর থেকেই প্রশিক্ষণ ও ঋণ পেয়েছেন তিনি। আর বর্তমানের এ স্বীকৃতি সেই পথে হেঁটেই।

রেশমা বললেন, ‘আমি আমার মতো কাজ করতাম। গুছিয়ে হিসাব রাখা, ছবি রাখা—এগুলো করতাম না। অধিদপ্তরের উপপরিচালক তোসাদ্দেক হোসেনসহ অন্য স্যারেরা আমার খামার ভিজিটে এসে এগুলো শিখিয়েছেন। আমার লাভ কত, মূলধন কত—খামারের প্রতিটা জিনিস ধরে ধরে স্যারেরাই হিসাবটা করে দিয়েছেন। আমি তাঁদের কাছে কৃতজ্ঞ।’

স্বামীর বাড়ি থেকে ফেরার পর কিছু একটা করবেন বলে জেদ চাপে রেশমার। একসময় কাপড় সেলাই করা শুরু করেন। তবে বুঝতে পেরেছিলেন, শুধু কাপড় সেলাই করে খুব বেশি দূরে যাওয়া সম্ভব নয়।

নিজের সমন্বিত কৃষি খামার নিয়ে বলতে গিয়ে রেশমা তাঁর উদ্যোগের ফিরিস্তি দেওয়া শুরু করেন। ২০১৪ সালে যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর থেকে বিনা মূল্যে গরু মোটাতাজাকরণ, মাছ চাষ, সেলাইসহ বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষণ নেন তিনি। অধিদপ্তর থেকে প্রথমে ৫০ হাজার টাকা ঋণ নেন। এরপর ৭৫ হাজার ও ১ লাখ টাকা ঋণ নেন এবং পরিশোধও করেন। ছোট পরিসরে খামার শুরু করেন ২০১৪ সালের শেষ দিকে।

রেশমা বললেন, যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের কাছ থেকে নেওয়া ৫০ হাজার টাকা, মায়ের কাছ থেকে নেওয়া টাকা, নিজের জমানো টাকাসহ মোট ৬৫ হাজার টাকা দিয়ে একটি গরু আর ছাগল কেনেন। তারপর কেঁচো সার নিয়ে কাজ শুরু করেন। এভাবে আস্তে আস্তে উদ্যোগের পরিসর বাড়তে থাকে। বর্তমানে তাঁর খামারে শ্রমিকদের প্রতি মাসে বেতন ৬ থেকে ১২ হাজার টাকা।

নিজের খামারের বর্ণনা দিতে গিয়ে রেশমা বলেন, খামারে কেঁচো সার তৈরির জন্য এখন রিংয়ের সংখ্যা ২০০। প্রতি মাসে একেকটি রিং থেকে প্রায় ৩৫ কেজি সার পান। ফলের ঝুড়িতেও সার তৈরি করছেন। একেকটা ঝুড়ি থেকে মাসে ১৪ কেজি সার পাওয়া যায়। ঝুড়ির সংখ্যা ২০০টির বেশি। হাউস বা চৌবাচ্চা পদ্ধতিতেও সার তৈরি করছেন। একেকটি চৌবাচ্চায় ২০০ কেজি পর্যন্ত সার পাওয়া যায়। এমন চৌবাচ্চা আছে ৬৫টি।

বর্তমানে রেশমা প্রতি মাসে প্রায় ২৫ টন ভার্মি কম্পোস্ট সার উৎপাদন করেন। এসব কেঁচো সার বাড়ি থেকে পাইকারি ১০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করেন। অনলাইনে সর্বোচ্চ ১৫ টাকা কেজিতে বিক্রি হয়।

রেশমার খামারে গরু আছে ২৫টি। ৬টি গাভি দিনে ৩০ থেকে ৩৫ কেজি দুধ দেয়। দুধ বিক্রি করেন ৫০ টাকা কেজি দরে। ছাগল আছে ১৫টি। হাঁস ১২০টি। দেশি মুরগি ২০০টির বেশি। কবুতর, পুকুরের মাছ ও নিরাপদ সবজি তো আছেই। জমিতে ধান চাষও হচ্ছে। গরুর মাংস ছাড়া রেশমাদের বাইরে থেকে তেমন কিছুই কিনতে হয় না। বাড়িসহ তাঁদের মোট জমির পরিমাণ ছয় বিঘা।

রেশমা বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনে (বিসিক) নিবন্ধন করেছেন। তাঁর ট্রেড লাইসেন্স আছে। এবার তিনি করও দেবেন। ফেসবুক পেজে রেশমার কার্যক্রম দেখে ৪০ জেলার ৪০০ জন তাঁর কাছ থেকে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। বাড়িতেই এই প্রশিক্ষণের আয়োজন করেছেন রেশমা।
ইন্টারনেট ঘেঁটে ‘ব্ল্যাক সোলজার ফ্লাই’ চাষ করছেন বলে জানালেন রেশমা। এটি মূলত মাছিজাতীয় একটি প্রাণীর লার্ভা। এ লার্ভা হাঁস ও মুরগির আমিষের চাহিদা পূরণ করে। এভাবে যখন যে তথ্য পান, তা কাজে লাগানোর চেষ্টা করেন। এ ছাড়া তিনি মাসে প্রায় ২০ টন ট্রাইকো কম্পোস্ট সার উৎপাদন করছেন। গোবর, ফেলে দেওয়া চা–পাতা, হাড়ের গুঁড়া, পচনশীল বিভিন্ন পণ্য ও ট্রাইকো টার্মা পাউডার মিশিয়ে এই সার তৈরি করা হয়।

প্রশিক্ষণও দিচ্ছেন রেশমা
রেশমা বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনে (বিসিক) নিবন্ধন করেছেন। তাঁর ট্রেড লাইসেন্স আছে। এবার তিনি করও দেবেন। ফেসবুক পেজে রেশমার কার্যক্রম দেখে ৪০ জেলার ৪০০ জন তাঁর কাছ থেকে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। বাড়িতেই এই প্রশিক্ষণের আয়োজন করেছেন রেশমা।

প্রশিক্ষণার্থীদের কাছ থেকে এক হাজার করে টাকা নেন রেশমা। তাঁদের খাবারের ব্যবস্থা করা, খাতা-কলম দেওয়াসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা দেন তিনি। জানালেন, প্রত্যেক প্রশিক্ষণার্থীর পেছনে এক হাজার টাকার বেশি খরচ হয় তাঁর। রেশমার ভাষায়, ‘সব জায়গায় তো আর ব্যবসা করা যায় না।’

একইভাবে রেশমার খামারে যে শ্রমিকেরা কাজ করেন, তাঁদের সকালের খাবারের ব্যবস্থা করেন তিনি। মাঝেমধ্যে দুপুরের খাবারের ব্যবস্থাও করেন। খামারের শ্রমিকদের সঙ্গে রেশমা গরুর ঘর পরিষ্কার করাসহ সব কাজেই হাত লাগান। তাঁর কথায়, তিনি দেখিয়ে না দিলে শ্রমিকেরা অনেক সময় কাজ বুঝতে পারেন না।

মা ও মেয়ে নিজেদের জীবনের গল্প বলতে গিয়ে কখনো কান্নায় ভেঙে পড়ছিলেন, কখনো আবার গলা জড়িয়ে ধরে আনন্দের হাসি হাসছিলেন। মা ও মেয়ে মনে করেন, তাঁরা তাঁদের সংগ্রামে জয়ী হয়েছেন। এখন যেখানেই যান, মানুষের কাছ থেকে সম্মান পান।

রেশমা বলেন, বিদেশিরা তাঁর খামার দেখতে আসেন। সরকারের উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তারাও আসেন। এখন গ্রামের মানুষ স্বীকার করেন, অন্য ছেলেরা যা করতে পারেনি, তা–ই করে দেখিয়েছেন তিনি। অথচ কেঁচো সার নিয়ে কাজ করেন বলে শুরুর দিকে কেউ কেউ তাঁকে ঘৃণাও করতেন। রেশমা ভবিষ্যতে বড় কিছু হতে চান। তাঁর মতো অন্য নারীদের উদ্যোক্তা হিসেবে তৈরি করতে চান।

শেয়ার করুন:

Facebook
Twitter
Pinterest
LinkedIn

সম্পর্কিত পোস্ট

দেড়শ নারীকে স্বাবলম্বী করছেন ফেরদৌসি পারভীন!

পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি নারীদের একটা অংশ উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত। কিন্তু পুঁজির অভাবে অনেকেই উদ্যোক্তা হয়ে উঠতে পারছে না। থামি. পিননসহ বিভিন্ন ঐতিহ্যবাহী পোশাক প্রস্তুত করতে

উদ্যোক্তাদের জন্য মানসিক চাপ কমানোর কিছু পন্থা

আমরা আজকে উদ্যোক্তাদের জন্য আলোচনা করবো মানসিক চাপ কমানোর পন্থা নিয়ে কারন উদ্যোক্তারা অনেকেই মানসিক চাপ নিয়ে তার উদ্যোগ কে সফলার দিকে নিয়ে যেতে পারে

বাড়ির ছাদে ছাগল পালন করে স্বাবলম্বী রায়হান!

‘পরিবারে কোনো আর্থিক অনটন ছিল না। পড়েছি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে। তাই আমার মতো ছেলে কেন ছাগল পালন করবে, এটাই ছিল মানুষের আপত্তির কারণ। কিন্তু মানুষের সেসব