ফেরিওয়ালা থেকে দুই ভাই এখন বড় ব্যবসায়ী

গাইবান্ধার শ্রীকলা গ্রামের মোস্তফা শেখ। তাঁর ছোট ভাই জরিফ শেখ। দুই ভাইয়ের গল্পটা অন্য রকম। দুজনই ফেরি করে দুধ বিক্রি করতেন। প্রতিদিন তিন লিটার দুধ বেচাকেনাই ছিল ভরসা। জেলা শহরের বাসায় বাসায় দুধ সরবরাহ করতেন। এখন ফেরি করে দুধ বিক্রি করতে হয় না। ঘরে বসেই তাঁরা প্রতিদিন ১৩ হাজার লিটার দুধ কিনছেন। তাঁদের দুধ দিচ্ছেন প্রায় আড়াই হাজার খামারি। তিন হাজার লিটার কারখানার কাজে লাগাচ্ছেন। বাকিটা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে বিক্রি করে আয় করছেন। তিন বিঘা জমিতে গড়ে তুলেছেন কারখানা। সেখানে তৈরি করছেন দই ও নানা প্রকার মিষ্টি। তাঁদের কারখানায় ১৭৫ শ্রমিকের কর্মসংস্থান হয়েছে। দুই ভাই এখন স্বাবলম্বী।

গাইবান্ধা শহর থেকে ১১ কিলোমিটার দূরে সাদুল্যাপুর উপজেলার তরফবাজিত এলাকা। এখানে গড়ে উঠেছে দুধ ক্রয়-বিক্রয় ও দুগ্ধজাত পণ্য বহুমুখীকরণ কেন্দ্র। কেন্দ্রটি সাদুল্যাপুর-মাদারগঞ্জ সড়ক ঘেঁষে অবস্থিত। এর নাম দেওয়া হয়েছে ‘শেখ দই ঘর’। এটি ২০১২ সালে গড়ে ওঠে। এখানকার দই মিষ্টি সারা জেলায় সরবরাহ হচ্ছে।

সরেজমিনে দেখা গেছে, কেন্দ্রে ঢুকতেই মিষ্টি ও দইয়ের দোকান। এরপর বড় বড় চিলিং প্ল্যান্টে (দুধ শীতলীকরণ প্রক্রিয়া) রাখা দুধ। এখানে খামারিরা গ্রাম থেকে দুধ এনে বিক্রি করছেন। ভেতরে তৈরি হচ্ছে দই, ঘি। পাশে তৈরি হচ্ছে নানা প্রকারের মিষ্টি। শ্রমিকদের কেউ দই তৈরি করছেন, কেউ মিষ্টি, কেউ বিক্রি করছেন।

শ্রীকলা গ্রামটি সাদুল্যাপুর উপজেলার জামালপুর ইউনিয়নে। গ্রামের সচ্ছল কৃষক ছিলেন আবু বকর শেখ। ছোটবেলায় দুই ভাই বাবা আবু বকরকে হারান। তাই তাঁদের লেখাপড়া হয়নি। মোস্তফা শেখ (৩৬) অষ্টম ও জরিফ শেখ (৩৩) ষষ্ঠ শ্রেণি পাস। বাবার মৃত্যুর পর সংসারের দায়িত্ব পড়ে দুই ভাইয়ের কাঁধে। বাধ্য হয়ে মোস্তফা শেখ শুরু করেন দুধের ব্যবসা। তখন তাঁর বয়স ছিল ১৮ বছর। নিজের গাভির দুধ হতো আধা কেজি। বাকি আড়াই কেজি পাইকারিতে কেনেন। প্রতিদিন তিন কেজি দুধ নিয়েই গাইবান্ধা জেলা শহরে যান। বাইসাইকেলে বাড়ি থেকে ১৫ কিলোমিটার পাড়ি দিতেন। তারপর শহরের বাসায় বাসায় ফেরি করে বিক্রি করতেন। ২০০৬ সালে তিনি একটি দুধের কারখানায় চাকরি পান। এরপর ছোট ভাই জরিফ শেখ ১৬ বছর বয়সে একই ব্যবসা শুরু করেন।

মোস্তফা ও জরিফ শেখ ২০১২ সাল থেকে ঘরে বসেই প্রতিদিন ১৩ হাজার লিটার দুধ কিনছেন। প্রায় আড়াই হাজার খামারি তাঁদের দুধ দেন। তিন বিঘা জমিতে দুধ ক্রয়-বিক্রয় ও দুগ্ধজাত পণ্য বহুমুখীকরণ কেন্দ্র। সেখানে দই ও নানা প্রকার মিষ্টি তৈরি করছেন। তিন হাজার লিটার দিয়ে দই ও মিষ্টি তৈরি করছেন। বাকিটা বিভিন্ন কোম্পানিতে বিক্রি করছেন। তাঁদের অধীন বর্তমানে ১৭৫ শ্রমিক কাজ করছেন।

দুই ভাইয়ের কারখানায় কর্মরত রংপুরের মিঠাপুকুর এলাকার সুজন মিয়া (২৫) বলেন, ‘দই তৈরির কাজ করে মাসিক ১৫ হাজার টাকা পাচ্ছি। এখানে কাজ করে সংসারে সচ্ছলতা ফিরেছে।’ সাদুল্যাপুরের শ্রীকলা গ্রামের রানু মিয়া (৩০) বলেন, ‘আগে দিনমজুরের কাজ করতাম। এখন মিষ্টি তৈরির কাজ করছি। আমার সংসারে অভাব নেই।’

সাদুল্যাপুর উপজেলার পাটানোছা এলাকার খামারি এরশাদ মিয়া (৪৫) বলেন, ‘আগে দুধ বিক্রি নিয়ে সমস্যায় পড়েছি। এখন দুই ভাইয়ের কারখানায় প্রতি কেজি ৪৬ টাকা হিসাবে প্রতিদিন ১৫০ লিটার দুধ নগদে বিক্রি করছি।’

মোস্তফা ও জরিফের ১৫ সদস্যের সংসার। মোস্তফা শেখ তিন সন্তানের বাবা। বড় ছেলে রিয়াজ মিয়া সপ্তম ও বড় মেয়ে মুরশিদা প্রথম শ্রেণিতে পড়ে। ছোট মেয়ে মুনিয়ার বয়স দুই। স্ত্রী রনজিলা বেগম গৃহিণী। জরিফ শেখেরও তিন সন্তান। বড় ছেলে রিফাত সপ্তম ও ছোট ছেলে শাহজালাল প্রথম শ্রেণিতে পড়ে। ছোট মেয়ে জান্নাতির বয়স তিন বছর। স্ত্রী সাথী বেগম গৃহিণী। মোস্তফা ও জরিফের বৃদ্ধ মা জরিনা বেগম (৭১)। তাঁদের দুই বোন আছমা ও মিনারা বেগম। তাঁরা সবার বড়। তাঁদের বিয়ে হয়েছে। এর মধ্যে আছমা বেগম তিন সন্তান নিয়ে ভাইদের সংসারে থাকেন। এক হাঁড়ির রান্নায় সবার খাওয়াদাওয়া চলে।

জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা মো. মাছুদার রহমান সরকার বলেন, দুই ভাইয়ের কারণে জেলায় দুধের উৎপাদন ও গরুর খামারের সংখ্যা বেড়েছে। পাশাপাশি জেলার দুধের চাহিদা মেটাতে তাঁরা অগ্রণী ভূমিকা রাখছেন। তাঁদের প্রযুক্তিগত সহায়তা দেওয়া হচ্ছে।

শেয়ার করুন:

Facebook
Twitter
Pinterest
LinkedIn

সম্পর্কিত পোস্ট

দেড়শ নারীকে স্বাবলম্বী করছেন ফেরদৌসি পারভীন!

পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি নারীদের একটা অংশ উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত। কিন্তু পুঁজির অভাবে অনেকেই উদ্যোক্তা হয়ে উঠতে পারছে না। থামি. পিননসহ বিভিন্ন ঐতিহ্যবাহী পোশাক প্রস্তুত করতে

উদ্যোক্তাদের জন্য মানসিক চাপ কমানোর কিছু পন্থা

আমরা আজকে উদ্যোক্তাদের জন্য আলোচনা করবো মানসিক চাপ কমানোর পন্থা নিয়ে কারন উদ্যোক্তারা অনেকেই মানসিক চাপ নিয়ে তার উদ্যোগ কে সফলার দিকে নিয়ে যেতে পারে

বাড়ির ছাদে ছাগল পালন করে স্বাবলম্বী রায়হান!

‘পরিবারে কোনো আর্থিক অনটন ছিল না। পড়েছি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে। তাই আমার মতো ছেলে কেন ছাগল পালন করবে, এটাই ছিল মানুষের আপত্তির কারণ। কিন্তু মানুষের সেসব