উদ্যোক্তা হতে স্বামীর সহযোগিতা খুব জরুরি

গরমের দিনে প্রশান্তিময় কুলফির উদ্যোক্তা তাজ্জিত আক্তার সুমা। গাজীপুরের মেয়ে সুমা তিন সন্তানের জননী। তার স্বামী, ঢাকা অফিসার্স ক্লাবে বিভিন্ন মেলায় ইভেন্টের ডিজাইন করতেন। সেই সুবাদে ২০১৭ সালের ১৪ এপ্রিল অফিসার্স ক্লাবে বৈশাখি মেলার স্টলে তিনি আর তার সিনিয়র বন্ধু রকিবুল আমিন কুষ্টিয়ার কুলফি উঠিয়েছিলেন। মেলায় খুব ভালো সাড়া পেয়েছিল কুষ্টিয়ার কুলফি। তখনই তারা সিদ্ধান্ত নেন উদ্যোগটি চালিয়ে যাবেন। সেই থেকেই শুরু, তবে তখনও তা সুমার একক কিছু না।

সুমা জানান: আমার এই বিজনেসের মূল ভাবনা বা আইডিয়া যাই বলি না কেন সেটা ছিল আমার স্বামী ও তার খুবই কাছের সিনিয়র বড়ভাই রকিবুল আমিনের। তারা দুজনেই কুষ্টিয়ার সন্তান। তাই শুরুটা করেছিলেন কুষ্টিয়ার বিখ্যাত কুলফি দিয়ে। দু’জনের পার্টনারশিপেই মুলত বিজনেসটার গোড়াপত্তন। “ফোকফুড” নামটা আমার স্বামীর দেওয়া। এই নামে আমাদের ট্রেড লাইসেন্স করা, কোম্পানির নামেই অনলাইন পেজ খোলা।

“কিন্তু সমস্যা দেখা দিলো তারা দুজনই যার যার ব্যক্তিগত ব্যবসা ও চাকরি নিয়ে ব্যস্ত। সে কারণে এ বিজনেসটায় পুরোপুরি মনোযোগ দিতে পারছিলেন না । আমি ছিলাম তাদের ম্যানেজার, আবার আমিই ছিলাম মূল হিসাবরক্ষক। আমার স্বামী অফিস থেকে ফিরে বিভিন্ন রেস্টুরেন্ট ও মিনি শপগুলিতে মার্কেটিং করে করে এটার একটা মার্কেট ভ্যালু দাঁড় করান। টেস্টটা খুব ভালো হওয়ায় ধীরে ধীরে ব্যবসাটা চালু হতে থাকে। একটা সময় গিয়ে আমার স্বামী বিজনেজটায় টুকটাক সময় দিতে পারলেও তার সিনিয়র বন্ধু একদমই পারছিলেন না। পরে তিনি নিজ থেকেই তার শেয়ার ফেরত চাইলেন। ধীরে ধীরে আমার স্বামীও ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। বিজনেসটা বন্ধ হওয়ার উপক্রম হচ্ছিল। পরে আমার স্বামী রকিবুল ভাইয়ের শেয়ার পরিশোধ করে পুরো বিজনেসটা আমার নামে লিখে দেন। তাই আমি এটার নতুন একটা নাম দেই ‘ফোক ফুড বাই সুমা’। সেই থেকে কুষ্টিয়ার কুলফি নিয়ে আমার উদ্যোক্তা যাত্রা,” বলে জানালেন তিনি।

সুমা জানান, শুরুতে তাদের পুঁজি ছিল কারিগরের সাথে সু-সম্পর্ক। ”অফিসার্স ক্লাবে বৈশাখি মেলার জন্য এক হাজার পিছ কুলফি অর্ডার দেই। তা বিক্রি করেই কারিগরের অংশ কারিগরকে বুঝিয়ে দিয়ে আমাদের লভ্যাংশ দিয়ে আমরা আবার স্বল্প পরিসরে কুলফি অর্ডার দেই। ওই মেলায় যে এক হাজার কুলফি আমরা এনেছিলাম তা সন্ধ্যা হওয়ার আগেই শেষ হয়ে যায়। অফিসার্স ক্লাবের ক্যান্টিনে সাপ্লাই দিয়ে প্রথম যাত্রা শুরু করি। এরপর বিভিন্ন রেস্ট্রুরেন্ট ও মিনিশপ ও সুপার শপগুলোতে প্রচার চালাতে থাকি। বতর্মানে আমার মাসে সেল হয় প্রায় ৭০ থেকে ৮০ হাজার টাকার মতো।”

তাদের নিজস্ব কোন কারখানা নেই, এটা একটা চুক্তিভিত্তিক উদ্যোগ। কারিগর কুষ্টিয়ার নামকরা একজন কুলফি বিক্রেতার সন্তান। তার বাবা মারা গেছেন বহু বছর আগে। কিন্তু সেই স্বাদ ও মান রক্ষা করে চলেছেন তার সন্তান ও বংশধরেরা। তাদের সাথে আমরা ব্যবসায়িক চুক্তি করি। সেই চুক্তি অনুযায়ী আমরা আমাদের কুলফি তাদের কাছে অর্ডার দেই।

সুমা বলেন, “সত্য কথা বলতে একই স্বাদের কুলফি ঢাকাতে বানানোরও আমরা চেষ্টা করি। কিন্তু বহুবার চেষ্টা করেও কুষ্টিয়ার স্বাদ আমরা আনতে পারিনি। কুষ্টিয়ার কারিগর দিয়েও ঢাকাতে চেষ্টা করেছি, তারপরও ব্যর্থ হয়েছি। আসলে ভৌগলিক কারণেই তো একেক অঞ্চলের খাবারের টেস্ট একেক রকম হয়। সেই কারণেই হয়তো আমরা ঢাকাতে একই স্বাদের কুলফি তৈরি করতে পারিনি। যেমন ধরুন কুষ্টিয়ার আখ, ঘাস খুব ভালো হয়– এটা সবাই জানে। সেই ঘাস গরু খেয়ে আমাদের খাঁটি দুধ দিচ্ছে, আবার সেই আখের চিনি দিয়েই কুলফি বানানো হচ্ছে। টেস্ট তো আলাদা হবেই।”

উদ্যোগের পাঁজ বছর হলেও করোনাকালীন লকডাউনে প্রচুর লোকসান হয়েছিল তার। তিনি বলেন: ওইসময় অনেক দোকানী-রেস্টুরেন্ট মালিক আমাদের পাওনা দিতে অস্বীকৃতি জানান। আমরাও পরিস্থিতি দেখে তেমন জোরাজুরি করিনি। শুধু এটুকু বলেছি যে, সবকিছু স্বাভাবিক হলে যদি আবার সাপ্লাই দেই তাহলে নগদ টাকায় নিতে হবে। তাই এখন তারা নগদেই অর্ডার দেয়। আর লকডাউনে টিকে থাকার জন্য অনলাইনে বুস্ট করে অর্ডার নিতে থাকি। কাস্টমারদের দোয়া ও ভালোবাসায় এখনও অনলাইন চালু রেখেছি।

উদ্যোক্তা তাজ্জিত আক্তার সুমা বলেন: আমার স্বামীই আমার উৎসাহদাতা। ওর সাহায্য ছাড়া আমি একদমই অচল। তবে কর্মচারি পরিচালনার সব দায়িত্ব আমার। সংসারের যাবতীয় খরচ এখন আমিই চালাই। স্বামীকে শুধু বাচ্চাদের পড়াশোনার খরচ, ফ্ল্যাটের হোমলোন পরিশোধের দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়েছি।

ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে সুমা জানান, সিগনেচার আইটেম কুলফির মান ভালো হওয়ায় অনেক কাস্টমার দই চেয়েছে। তাই বগুড়া থেকে মাটির কাপের দই এখন বাজারে এনেছেন, সেটাও ভালো চলছে। সেই সাথে রেখেছেন পাবনার ঘি। “আমি সব সময়ই চেষ্টা করি ঐতিহ্যবাহী খাবার নিয়ে কাজ করতে, সামনে কুমিল্লার রসমালাই নিয়েও কাজ করবো। গুণগত মান অক্ষুণ্ন রেখে বাংলাদেশের প্রতিটি জেলায় ‘ফোক ফুড বাই সুমা’ র খাবার পরিচিত করতে চাই।”

শেয়ার করুন:

Facebook
Twitter
Pinterest
LinkedIn

সম্পর্কিত পোস্ট

দেড়শ নারীকে স্বাবলম্বী করছেন ফেরদৌসি পারভীন!

পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি নারীদের একটা অংশ উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত। কিন্তু পুঁজির অভাবে অনেকেই উদ্যোক্তা হয়ে উঠতে পারছে না। থামি. পিননসহ বিভিন্ন ঐতিহ্যবাহী পোশাক প্রস্তুত করতে

উদ্যোক্তাদের জন্য মানসিক চাপ কমানোর কিছু পন্থা

আমরা আজকে উদ্যোক্তাদের জন্য আলোচনা করবো মানসিক চাপ কমানোর পন্থা নিয়ে কারন উদ্যোক্তারা অনেকেই মানসিক চাপ নিয়ে তার উদ্যোগ কে সফলার দিকে নিয়ে যেতে পারে

বাড়ির ছাদে ছাগল পালন করে স্বাবলম্বী রায়হান!

‘পরিবারে কোনো আর্থিক অনটন ছিল না। পড়েছি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে। তাই আমার মতো ছেলে কেন ছাগল পালন করবে, এটাই ছিল মানুষের আপত্তির কারণ। কিন্তু মানুষের সেসব