বাবা প্রতিষ্ঠিত জোতদার। নিজের জমিতে সারা বছর বিভিন্ন ফসল ফলান। ২০০৫ সালে হজ করতে যান তিনি। বাবার অনুপস্থিতিতে দুই মাস জমিজমা দেখাশোনার দায়িত্ব পান সম্মান শ্রেণিপড়ুয়া হালিম সরকার। তখনই তিনি কৃষির প্রতি আকৃষ্ট হন। তাই লেখাপড়া শেষ করে চাকরির পেছনে ছোটেননি তিনি। গ্রামে ফিরে বাবার জমিতে শুরু করেন চাষবাস।
প্রচলিত ফসলের বাইরে বিভিন্ন ফল চাষ শুরু করেন হালিম সরকার, সফলতাও পেয়েছেন। এখন শুধু পেয়ারা বিক্রি করেই বছরে কোটি টাকার ওপরে আয় করছেন তিনি।
হালিমের বাড়ি টাঙ্গাইলের মধুপুর উপজেলার কুড়াগাছা ইউনিয়নের ভবানিটেকি গ্রামে। তিনি ওই গ্রামের মজিবর রহমান ও হাফিজা বেগমের ছেলে। তিনি ময়মনসিংহের আনন্দ মোহন কলেজ থেকে সমাজকল্যাণে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেওয়ার পর গ্রামে ফিরে আসেন ২০১০ সালে। শুরুতে বাবার মতো তিনিও আনারস, ধান ও সবজি আবাদ করতেন। কয়েক বছর পর তাঁর মনে হয়, লাভজনক ফল চাষের কথা। ইউটিউব ঘেটে দেখতে পান, রাজশাহী অঞ্চলে পেয়ারা চাষ করে চাষিরা অনেক লাভবান হচ্ছেন। সেখান থেকে পেয়ারা চাষের প্রতি উদ্বুদ্ধ হন তিনি।
২০১৫ সালে রাজশাহী থেকে থাই-৩ জাতের ৪ হাজার চারা আনেন হালিম। ২১ বিঘা জমিতে এই চারা দিয়ে পেয়ারাবাগান করেন। কিন্তু অভিজ্ঞতার অভাবে সফল হতে পারেননি, তবে দমে যাননি তিনি। রাজশাহীতে গিয়ে মাসখানেক থেকে সরেজমিনে প্রত্যক্ষ করেন পেয়ারা চাষের কলাকৌশল। ২০১৮ সালে ৩৬ বিঘা জমিতে আবার ৭ হাজার চারা লাগান। সাত-আট মাস পরই ফল আসতে শুরু করে। দেড় বছরের মাথায় পুরোদমে উৎপাদন শুরু হয়। বর্তমানে তাঁর বাগানে প্রায় ছয় হাজার পেয়ারাগাছ ফল দিচ্ছে। প্রতিটি গাছ থেকে বছরে গড়ে দেড় মণ পেয়ারা বিক্রি করতে পারেন।
গতকাল শনিবার দুপুরে ভবানিটেকি গ্রামে হালিমের পেয়ারাবাগানে গিয়ে দেখা যায়, পুরো বাগানে গাছভর্তি থরে থরে পেয়ারা ধরে আছে। শ্রমিকেরা নতুন পেয়ারার গুটিগুলো পলিথিন ব্যাগে ভরে দিচ্ছেন। তাঁরা জানান, পোকামাকড়ের হাত থেকে রক্ষা এবং কীটনাশক যাতে ফলের গায়ে না লাগে, সে জন্য এই পলিথিন ব্যাগে পেয়ারার গুটি ভরে দেওয়া হচ্ছে। এতে পেয়ারা নিরাপদে থাকবে। পাশাপাশি রংও হবে আকর্ষণীয়।
হালিম জানান, বছরে এখন প্রায় দেড় কোটি টাকার পেয়ারা বিক্রি করতে পারেন। সব খরচ বাদ দিয়ে কোটি টাকার বেশি লাভ হয়। টাঙ্গাইল ও আশপাশের জেলা থেকে পাইকাররা বাগানে এসে পেয়ারা নিয়ে যান। ট্রাকে করে ঢাকার ফলের আড়তে পাঠানো হয় পেয়ারা।
পেয়ারা চাষে হালিমের সফলতা দেখে এ অঞ্চলের অনেকেই বাণিজ্যিক ভিত্তিতে পেয়ারা চাষ শুরু করেছেন। তাঁরাও লাভবান হচ্ছেন। তাঁকে দেখে ভবানিটেকি গ্রামের আমিরুল ইসলাম ১০ বিঘা জমিতে পেয়ারাবাগান করেছেন। উপজেলা সদরের খন্দকার তানিম ইদিলপুর গ্রামে ১৫ বিঘা জমি ইজারা নিয়ে গড়ে তুলেছেন পেয়ারাবাগান।
হালিম বলেন, ওই ২ জনসহ অন্তত ২৭ জন তাঁর কাছে পেয়ারা চাষে হাতে–কলমে শিক্ষা নিয়েছেন। তাঁরা পেয়ারাবাগান করে লাভবান হচ্ছেন।
মধুপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আল মামুন রাসেল জানান, মধুপুরের মাটির গুণাগুণের কারণে পেয়ারা অনেক সুমিষ্ট ও আকর্ষণীয় হচ্ছে। তাই সারা দেশে এর চাহিদা বাড়ছে। হালিম প্রথমে পেয়ারা চাষ শুরু করেছিলেন। তাঁর সফলতা দেখে এখন আরও অনেকেই পেয়ারা চাষে ঝুঁকছেন।
পেয়ারা ছাড়াও হালিম ৩০ বিঘা জমিতে কলা, ১৭ বিঘা জমিতে ভুট্টা, ২৫ বিঘা জমিতে ধান, ৩ বিঘা জমিতে কফি, ৬ বিঘা জমিতে মাল্টা, ১২০ বিঘা জমিতে আনারস ও ৩০ শতাংশ জমিতে কাজুবাদাম চাষ করছেন।