দুঃসময়ে নারীরাই ধরে সংসারের হাল

ইলিশ আহরণে বিরত থাকা জেলেদের সরকার ভিজিএফের মাধ্যমে খাদ্যসহায়তা দেয়। তবে এ সহায়তা যেসব জেলে পান না, তাঁরা দুর্ভোগে পড়েন। ভোল সদর উপজেলার ধনিয়া ইউনিয়নের বাঁধের বাইরে বলরামসুরা ও গঙ্গাকৃতি গ্রামের বেশির ভাগ জেলে নদীতে মাছ ধরার ওপর নিষেধাজ্ঞা মেনে চলেন। জেলে পরিবারের নারীরা বিকল্প আয়ের মাধ্যমে সংসারের হাল ধরছেন। তাঁরা বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি সংস্থা থেকে প্রশিক্ষণ ও আর্থিক সহায়তা পেয়েছেন।

ভেদুরিয়া, ধনিয়া ইউনিয়নসহ ভোলার আট হাজার জেলে পরিবারের নারীকে আয়বর্ধনমূলক কাজের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। তাঁদের বিনা মূল্যে হাঁস-মুরগি, ছাগল, সবজির বীজ ও ওষুধ দেওয়া হয়েছে
ভেদুরিয়া, ধনিয়া ইউনিয়নসহ ভোলার আট হাজার জেলে পরিবারের নারীকে আয়বর্ধনমূলক কাজের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। তাঁদের বিনা মূল্যে হাঁস-মুরগি, ছাগল, সবজির বীজ ও ওষুধ দেওয়া

রুনা বেগম ও মো. খোকন দম্পতি দিন আনেন দিন খান। রুনা গৃহবধূ। খোকন মাছ ধরে সংসার চালান। তিনি অন্যের নৌকায় ভাগী হিসেবে (প্রাপ্ত মাছের একটা অংশ পান) মাছ ধরেন। কিন্তু ইলিশ শিকারে নিষেধাজ্ঞা অভিযানের সময়, যখন নদীতে জাল ফেলা নিষিদ্ধ থাকে, তখন তাঁরা সমস্যায় পড়েন। খোকনের আয় থাকে না। এ সময় কিছুটা হলেও সংসারের হাল ধরেন রুনা বেগম। সংসারের দৈনন্দিন কাজের পাশাপাশি তিনি কাঁথা-কাপড় সেলাই ও হাঁস-মুরগিও পোষেন।

প্রজনন মৌসুমে ইলিশ রক্ষায় ৭-২৮ অক্টোবর ২২ দিন সারা দেশে এই মাছ শিকার বন্ধ থাকে। এ সময় দেশব্যাপী ইলিশ পরিবহন, কেনাবেচা, মজুত ও বিনিময়ও নিষিদ্ধ থাকে। জাটকা ইলিশ (২৫ সেন্টিমিটার) যাতে বড় হতে পারে, তাই বছরের প্রায় নভেম্বর থেকে জুন পর্যন্ত জাটকা ধরা নিষিদ্ধ থাকে। যদিও বড় সাইজের ইলিশ ধরার ক্ষেত্রে কোনো নিষেধাজ্ঞা থাকে না। এ ছাড়া ২০ মে থেকে ২৩ জুলাই পর্যন্ত এই ৬৫ দিন বঙ্গোপসাগরে সব ধরনের মাছ ধরার ওপর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। ইলিশ আহরণে বিরত থাকা জেলেদের সরকার ভিজিএফের মাধ্যমে খাদ্যসহায়তা দেয়। তবে এ সহায়তা যেসব জেলে পান না, তাঁরা দুর্ভোগে পড়েন।

রুনা বেগম (৩২) ও মো. খোকন (৪৫) দম্পতির বাড়ি ভোলার সদর উপজেলার ভেদুরিয়া ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ডে চর ভেদুরিয়া গ্রামে তেঁতুলিয়া নদীর তীরে। রুনা বেগম বলেন, প্রতিবছর ৮৩ দিন নদীতে (মা ইলিশ প্রজনন ও জাটকা সংরক্ষণ মৌসুম) মাছ ধরার ওপর নিষেধাজ্ঞা থাকে। তখন স্বামীর পাশাপাশি তিনি নিজেও কিছু আয় করার চেষ্টা করেন। আট বছর আগে বেসরকারি সংস্থা কোস্ট ফাউন্ডেশন থেকে বিনা মূল্যে সেলাই প্রশিক্ষণ নেন। একই সঙ্গে একটি সেলাই মেশিন উপহার পান। এখন তিনি পাঞ্জাবিতে ফুল তোলেন, মেয়েদের জামাকাপড় ও কাঁথা সেলাই করেন। প্রতিদিন তাঁর ১০০ থেকে ১৫০ টাকা আয় হয়। এ টাকা জমা রাখেন। এ ছাড়া বাড়িতে হাঁস-মুরগি পোষেন। সব মিলিয়ে যে আয় হয়, তা দিয়ে এক মেয়ে ও দুই ছেলেকে পড়ালেখা করাচ্ছেন। স্বামীর বেকার সময়ে সংসারের হাল ধরেন তিনি।

রুনা বেগমের মতো ভোলার ভেদুরিয়া ও ধনিয়া ইউনিয়নে অনেক নারী বিকল্প আয়ের মাধ্যমে সংসারে হাল ধরছেন। তাঁরা বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি সংস্থা থেকে প্রশিক্ষণ ও আর্থিক সহায়তা পেয়েছেন। এ সম্পর্কে কোস্ট ফাউন্ডেশনের সমন্বয়কারী সোহেল মাহমুদ বলেন, তাঁরা ভেদুরিয়া, ধনিয়া ইউনিয়নসহ ভোলার আট হাজার জেলে পরিবারের নারীকে আয়বর্ধনমূলক কাজের প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। তাঁদের বিনা মূল্যে হাঁস-মুরগি, ছাগল, সবজির বীজ ও ওষুধ দেওয়া হয়েছে।

সেতারা বিবির (৪৬) বাড়িও ভেদুরিয়া গ্রামে। তাঁর তিন ছেলে তেঁতুলিয়া নদীতে মাছ ধরেন। তাঁর স্বামী আবদুল আজিজও একসময় মাছ ধরতেন। বার্ধক্যের কারণে এখন আর কাজ করতে পারেন না। মাছ শিকারে নিষেধাজ্ঞার সময় সংসার চালাতে তিনি সারা বছরই কিছু কিছু সঞ্চয় করেন। মাঝেমধ্যে বেসরকারি সংস্থা থেকে ঋণ নিয়ে হাঁস-মুরগি পোষেন। জমি লগ্নি নিয়ে ছেলেদের কৃষিকাজে লাগান। সেখানে খোরাকির ধান হয়। সবজি হয়। চার বছর আগে গ্রামীণ জন–উন্নয়ন সংস্থা নামের একটি বেসরকারি সংস্থা তাঁকে দুটি ছাগল ও একটি খাঁচা দেয়। ওই ছাগল বেড়ে এখন প্রায় ১৫টি হয়েছে। অনেকগুলো খাসি বিক্রিও করেছেন।

ভোলার সদর উপজেলার ধনিয়া ইউনিয়নের বাঁধের বাইরে বলরামসুরা ও গঙ্গাকৃতি গ্রাম ঘুরে জানা যায়, এখানকার বেশির ভাগ জেলে নদীতে মাছ ধরার ওপর নিষেধাজ্ঞা মেনে চলেন। এ জন্য তাঁরা বিকল্প কর্মসংস্থানের ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন।

ধনিয়া ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) ৬ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য জাকির হোসেন বলেন, বলরামসুরা ও গঙ্গাকৃতি গ্রামের ৮০-৮৫ শতাংশ জেলে মৎস্য আইন মানছেন। জেলে বৌরা হাঁস-মুরগি, গবাদিপশু পালন করে দুঃসময়ের জন্য সঞ্চয় করেন।

সরকারি উদ্যোগে সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশনকে (এসডিএফ) দিয়ে একটি পাইলট প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মোল্লা এমদাদুল হক। তিনি বলেন, এ প্রকল্পের আওতায় ভোলায় ৭০টি জেলেগ্রাম তৈরি করা হয়েছে।

শেয়ার করুন:

Facebook
Twitter
Pinterest
LinkedIn

সম্পর্কিত পোস্ট

দেড়শ নারীকে স্বাবলম্বী করছেন ফেরদৌসি পারভীন!

পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি নারীদের একটা অংশ উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত। কিন্তু পুঁজির অভাবে অনেকেই উদ্যোক্তা হয়ে উঠতে পারছে না। থামি. পিননসহ বিভিন্ন ঐতিহ্যবাহী পোশাক প্রস্তুত করতে

উদ্যোক্তাদের জন্য মানসিক চাপ কমানোর কিছু পন্থা

আমরা আজকে উদ্যোক্তাদের জন্য আলোচনা করবো মানসিক চাপ কমানোর পন্থা নিয়ে কারন উদ্যোক্তারা অনেকেই মানসিক চাপ নিয়ে তার উদ্যোগ কে সফলার দিকে নিয়ে যেতে পারে

বাড়ির ছাদে ছাগল পালন করে স্বাবলম্বী রায়হান!

‘পরিবারে কোনো আর্থিক অনটন ছিল না। পড়েছি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে। তাই আমার মতো ছেলে কেন ছাগল পালন করবে, এটাই ছিল মানুষের আপত্তির কারণ। কিন্তু মানুষের সেসব