কফি চাষে সফল উদ্যোক্তা ছানোয়ার!

প্রায় ছয় বছর আগের কথা। টাঙ্গাইল শহর বাইপাসের একটি রেস্তোরাঁয় কফি পান করেন ছানোয়ার হোসেন। বিল দিতে গিয়ে দেখেন দাম ৫০ টাকা। দাম বেশি হওয়ার কারণ বাংলাদেশে কফির চাহিদা প্রায় পুরোটাই আমদানিনির্ভর। কফির অত্যধিক দাম ও শখ থেকেই দেশের মাটিতে কফি চাষের কথা মাথায় আসে ছানোয়ার হোসেনের।

তার হাত ধরে টাঙ্গাইলের মধুপুর গড়ের লাল মাটিতে কফি চাষ শুরু হয়েছে।। গড়াঞ্চলের মাটি, ভূ-প্রকৃতি, আবহাওয়া ও মাটির উর্বরতা ভালো থাকার কারণে কফি চাষের উজ্জল সম্ভাবনা রয়েছে বলে কৃষি বিভাগও ধারণা করছে। আর এই কফি চাষ করে এবার বঙ্গবন্ধু কৃষি স্বর্ণপদক পেয়েছেন ছানোয়ার হোসেন।

ছানোয়ার মধুপুর থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে নিজ গ্রাম মহিষমারায় বিভিন্ন ফল চাষ করতেন। কফি চাষের কথা মাথায় আসার পর তিনি শুধু তা মাথাতেই রাখেননি। ভাবনাকে বাস্তবে রূপ দিয়েছেন। মধুপুরের লাল মাটিতে গড়ে তুলেছেন কফি বাগান। কফি চাষে তার সফলতা দেখে আরও অনেকেই কফি চাষ শুরু করেছেন।

কৃষি উদ্যোক্তা ছানোয়ার জানান, চাকুরি ছেড়ে পাচঁ বছর আগে শখের বশে কফি চাষ শুরু করেন। কফি খুব দামি ফসল জানার পর খোঁজ করতে থাকেন, কোথায় এর চারা পাওয়া যায় এবং কীভাবে চাষ করতে হয়। ২০১৭ সালে জানতে পারেন, বান্দরবানের রায়খালী হর্টিকালচার সেন্টারে কফির চারা পাওয়া যায়। সেখানে গিয়ে চারা সংগ্রহ করেন। কফি চাষ সর্ম্পকেও জেনে আসেন। মধুপুরের মহিষমারা গ্রামে নিজ বাড়ির পাশে ৪০০ কফির চারা লাগান। দুই বছর পর ২০১৯ সালে কিছু গাছে দু-একটি ফল আসে। এতে উৎসাহ বেড়ে যায় তার। মনোযোগ দিয়ে পরিচর্যা শুরু করেন। পরের বছর ২০২০ সালে ফলে ফলে ভরে যায় প্রতিটি গাছ। প্রতিটি গাছ থেকে গড়ে দুই কেজি কফি ফল পান। ফল শুকিয়ে প্রক্রিয়াজাতকরণের পর প্রায় ৮৫ কেজি কফি পাওয়া যায়। তা বিক্রি করে ৮০ হাজার টাকা পান। এবারও প্রচুর ফল এসেছে প্রতিটি গাছে।

বাগানের কফির চারাগুলো দেখতে কিছুটা দেবদারুর চারার মত। প্রতিটি গাছে লতিয়ে রয়েছে গুচ্ছ গুচ্ছ কফির ফল। অপরিপক্ক কফি ফল অনেকটা কাঁচা বড়ই-এর মতো দেখতে। এই ফল পাকলে টকটকে লাল অথবা গোলাপী বর্ণ ধারণ করে। আষাঢ়-শ্রাবণ মাসে কফির চারা রোপণের উপযুক্ত সময়। সাধারণত মার্চ এপ্রিল মাসে কফি গাছে ফুল আসে, সেপ্টেম্বর নভেম্বর মাসে ফল পাকে। কফির ফল সংগ্রহের পর সেগুলো রোদে শুকিয়ে নিতে হয়। রোদের তাপে লাল কফি শুকিয়ে কালচে বর্ণ ধারণ করে। এরপর সেগুলো দেশীয় প্রযুক্তিতে উদ্ভাবিত পালপার মেশিনে কিংবা ঢেঁকিতে খোসা ছেটে বীজ আলাদা করা হয়। আবার কফির বীজ থেকে চারা উৎপাদনও করা যায়।

ছানোয়ার হোসেন তার উৎপাদিত কফি নিরাপদ ফল ও ফসল উৎপাদনকারী সমবায় সমিতির মাধ্যমে বিক্রি করে থাকেন। দেশে উৎপাদিত কফির চাহিদা যোগানের তুলনায় অনেক কম থাকায় ছানোয়ার হোসেন দামও পাচ্ছেন ভালো। প্রতি কেজি কাঁচা কফির দাম ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা, শুকনো কফি বিক্রি হচ্ছে ১,৫০০ থেকে ১,৮০০ টাকায়। আর প্রসেস হওয়ার পর প্রতি কেজি কফি ১,৮০০ থেকে ২,০০০ টাকায় বিক্রি হয়ে থাকে।

ছানোয়ার হোসেনের সাফল্যে মধুপুর অঞ্চলে কফি চাষ নিয়ে স্বপ্ন দেখছেন কৃষকরা। তার কফি বাগান পরিদর্শন করেছেন কৃষিমন্ত্রী ড. মো. আব্দুর রাজ্জাক। পরে কৃষি মন্ত্রণালয় মধুপুর ও পার্শ্ববর্তী ধনবাড়ী উপজেলায় কফিসহ কাজুবাদাম চাষ সম্প্রসারণের একটি প্রকল্প গ্রহণ করে। প্রকল্পের আওতায় কৃষকদের মাঝে কফির চারা বিতরণ করা হয়।

মধুপুর উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে, কাজু বাদাম এবং কফি গবেষণা উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ প্রকল্পের মাধ্যমে ২০২১-২২ অর্থ বছরে মধুপুরে ১১ হেক্টর জমিতে কফি চাষ শুরু হয়েছে। এ পর্যন্ত ৫৩ জন কৃষকের মাঝে সাড়ে সাত হাজার কফির চারা বিতরণ করা হয়েছে। পৃথিবীতে ৬০ প্রজাতির কফি থাকলেও বাণিজ্যিকভাবে দুই রকমের কফি চাষ হয়। ওই এলাকায় বাণিজ্যিকভাবে চাষের জন্য অ্যারাবিকা এবং রোবাস্টা জাতের কফি চাষ শুরু হয়েছে। চাষ উপযোগী আবহাওয়া ও জলবায়ু অনুকূল থাকায় ভালো, উন্নতমানের এবং ঘ্রাণের কফি চাষ সম্প্রসারণের জন্য পাহাড়ি এলাকায় বিশেষ কার্যক্রম চলমান অঅছে। রোবাস্টা জাতের কফি বাংলাদেশের আবহাওয়ায় খুব উপযোগী। যে কারণে পার্বত্য অঞ্চল ও টাঙ্গাইলের মধুপুর গড়ে এর সম্প্রসারণ সম্ভব।

মধুপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আল মামুন রাসেল জানান, মধুপুরের মাটিতে অম্লত্ব ও উর্বরতা শক্তি কফি চাষের জন্য উপযোগী। বৃষ্টিপাত মাটির গঠন বিন্যাস মিলে গড় এলাকার লাল মাটিতে কফি চাষের উজ্জ্বল সম্ভাবনা রয়েছে।

তিনি বলেন, এ এলাকায় সহজে বন্যার পানি উঠে না। তেমন খরা হয় না। কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাকের আন্তরিক সহযোগিতায় এলাকায় কাজু বাদাম ও কফি গবেষণা উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ প্রকল্পের মাধ্যমে এ পর্যন্ত ৫৩ জন কৃষকের ১১ হেক্টর জমিতে কফি চাষ শুরু হয়েছে। পর্যায়ক্রমে এর সম্প্রসারণ ও সফলতার জন্য তারা কাজ করে যাচ্ছেন।

ছানোয়ার মহিষমারা গ্রামের জামাল হোসেনের ছেলে। ১৯৯২ সালে ছানোয়ার স্নাতক ডিগ্রি লাভের পর সিলেটের একটি স্কুলে শিক্ষকতা শুরু করেন। পাঁচ বছর শিক্ষকতা করার পর নিজ গ্রামে ফিরে আসেন। প্রথমে এলাকার প্রচলিত আনারস চাষ করতেন। পরে বরই, মাল্টা, ড্রাগনসহ বিভিন্ন ফল চাষ করে সফল হন। এখন তিনি কফি রাজত্বের স্বপ্ন দেখছেন।

শেয়ার করুন:

Facebook
Twitter
Pinterest
LinkedIn

সম্পর্কিত পোস্ট

দেড়শ নারীকে স্বাবলম্বী করছেন ফেরদৌসি পারভীন!

পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি নারীদের একটা অংশ উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত। কিন্তু পুঁজির অভাবে অনেকেই উদ্যোক্তা হয়ে উঠতে পারছে না। থামি. পিননসহ বিভিন্ন ঐতিহ্যবাহী পোশাক প্রস্তুত করতে

উদ্যোক্তাদের জন্য মানসিক চাপ কমানোর কিছু পন্থা

আমরা আজকে উদ্যোক্তাদের জন্য আলোচনা করবো মানসিক চাপ কমানোর পন্থা নিয়ে কারন উদ্যোক্তারা অনেকেই মানসিক চাপ নিয়ে তার উদ্যোগ কে সফলার দিকে নিয়ে যেতে পারে

বাড়ির ছাদে ছাগল পালন করে স্বাবলম্বী রায়হান!

‘পরিবারে কোনো আর্থিক অনটন ছিল না। পড়েছি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে। তাই আমার মতো ছেলে কেন ছাগল পালন করবে, এটাই ছিল মানুষের আপত্তির কারণ। কিন্তু মানুষের সেসব